আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে একটি ছোটগল্প লিখলাম। তবে নিছক গল্প নয়, এখানে গল্পের মধ্যে দুটি মজার গাণিতিক ও যুক্তিমূলক ধাঁধা লুকিয়ে আছে। এগুলো চিন্তাশীল ও ধৈর্যশীল কিশোর-কিশোরীদের জন্য।
রিয়ান, সানি, লাবিব ও বল্টু চার বন্ধু। নিদিরপুর গ্রামে পাশাপাশি তাদের বাড়ি এবং তারা দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। একদিন বিকালে তারা তাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে তিরান দ্বীপে ঘুরতে গেল। সেখানে তাদের আরেক বন্ধু রাদিনের বাড়ি। তিরান যদিও গ্রামের নাম কিন্তু তার চারিদিকে জল থাকায় সেটি তিরানদ্বীপ নামেই বেশি পরিচিত। রান্তা নদী তিরানকে চারিদিকে বেষ্টন করে আছে। শুধুমাত্র নিদিরপুর গ্রামের দিকে একটি খাল রয়েছে এবং সেটি রান্তা নদীতেই মিশেছে। খালটির উপর অনেক বছরের পুরাতন একটি বাশের সাঁকো রয়েছে। চার বন্ধু খালের কাছাকাছি এসে দেখল সাঁকোটি এত পুরাতন যে এতে একসাথে ২ জনের বেশি ওঠলে, সাঁকোটি নিশ্চিত ভেঙ্গে পড়বে। তাই ওরা ঝুঁকি না নিয়ে একজন একজন করে সাঁকোটি পার হল। সানির সময়জ্ঞান কিছুটা বেশি। সে তার হাতঘড়ির সাহায্যে হিসাব করে দেখল, তার সাঁকোটি পার হতে ২ মিনিট লেগেছে। শুধু তাই নয়, রিয়ান, লাবিব ও বল্টুর যথাক্রমে ১,৫ ও ১০ মিনিট লেগেছে। সানি এটা কাউকে বলল না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা রাদিনদের বাড়ি আসলো যখন, তখন সুর্য প্রায় অস্ত চলে গিয়েছে। এসে দেখে রাদিন কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাদিনকে জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘আমাদের গ্রামে এক জাদুকর আসছে আজ। সন্ধ্যার পর সে জাদু দেখাবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, জাদুকরটি নাকি গণিত নিয়ে অনেক জাদু দেখায়!’ একথা শুনে চার বন্ধুও দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠল।
সন্ধ্যার পর জাদুকর জাদু দেখানো শুরু করল। গোলাপ ফুল থেকে কবুতর বানিয়ে ওড়ানো, মানুষ কেটে দ্বিখণ্ডিত করা, ইত্যাদি নানা জাদু দেখিয়ে সে মানুষদেরকে মুগ্ধ করে ফেলল। এরপর সে গণিতের জাদু দেখানো শুরু করল। বর্গ নিয়ে জাদু, মনের গোপন সংখ্যা জেনে নেওয়া, জন্মদিনের জাদু, ম্যাজিক বর্গের জাদু ইত্যাদি। পাঁচ বন্ধু বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় জাদুকে তারা খুব একটা বিশ্বাস করে না। যদিও চোখের সামনে ঘটছে, তবুও তাদের মনে হচ্ছে এর মাঝে কিছু চালাকি আছে কিন্তু সেটা তারা ধরতে পারছে না।
এরপর জাদুকর নতুন আরেকটি জাদু শুরু করল। সে বলল, ‘৫০ পয়সা, ২০ পয়সা আর ৫ পয়সা মিলিয়ে মোট ২০টি মুদ্রায় কেউ যদি আমাকে ৫ টাকা দিতে পারেন তা হলে আমি তাকে ৫০০ টাকা দেব। পাঁচ টাকায় পাঁচশো টাকা! নেবেন নাকি কেউ?’ কেউ কেউ কাগজ, পেন্সিল বাগিয়ে ধরে এমন একটা সুযোগ নেবার জন্য হিসেব কষতে শুরু করেছে। রিয়ানের প্যান্টের পকেটে সবসময় একটি কলম ও ভাঁজ করা সাদা কাগজ থাকে। সে সাথে সাথে কাগজ কলম বের করে কি যেন হিসাব করতে শুরু করল। বল্টু ও সানি কিছু জিজ্ঞেস করল কিন্তু উত্তেজনায় রিয়ান কিছু শুনতে পেল না। এদিকে কেউই রাজি হচ্ছে না দেখে জাদুকর বলল, ‘৫০০ টাকার জন্য ৫ টাকাকে আপনারা খুব বেশি বলে মনে করছেন দেখছি! আচ্ছা বেশ, ২০টি মুদ্রায় ৩ টাকা নিতে রাজি আছি আমি, তার বদলে দেব ৫০০ টাকা। যারা নেবেন লাইন করে দাঁড়ান।’ কেউই লাইনে দাঁড়াতে এল না। সহজে টাকা আয়ের এই সুযোগটা নিতে কেউই ব্যস্ততা দেখাল না। হঠাৎ রিয়ান চাপা উত্তেজনায় ফিসফিস করে বন্ধুদের বলল, ‘ধরে ফেলেছি মনে হয়। জাদুকরের সব জারিজুরি খতম। দাঁড়াও, আরেকবার একটু ভালো করে ভেবে নেই।’ চারবন্ধু কিছু বুঝল না। জাদুকর আবার বলল, ‘কী ব্যাপার! ৩ টাকাও খুব বেশি মনে হচ্ছে আপনাদের? আচ্ছা, আচ্ছা, আরও ১ টাকা কমিয়ে দিচ্ছি, ২০টা মুদ্রায় ২ টাকা দিন আপনারা। এবার হল তো?’ তবু কেউ সুযোগটা নিতে এল না। জাদুকর বলে চলল, ‘খুচরো মুদ্রাগুলি নেই বোধহয় আপনাদের কাছে? আচ্ছা বেশ, আমি বিশ্বাস করছি আপনাদের । কোন মুদ্রা কতটা করে দেবেন সেইটা শুধু লিখে দিন আমাকে। আমার দিক থেকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যারা এসব মুদ্রার একটি তালিকা আমাকে দেবেন তাঁদের প্রত্যেককে আমি ৫০০ টাকা দেব!’ এবার রিয়ান দাঁড়িয়ে উঠে জাদুকরকে বলল, ‘আপনার এই প্রস্তাব বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়। কেউ সারাজীবন হিসাব করলেও ৫০ পয়সা, ২০ পয়সা ও ৫ পয়সার ২০টি মুদ্রায় ২,৩ বা ৫ টাকা মিলিয়ে দিতে পারবে না, আর আপনি এটা জানেন বলেই এমন সুযোগ দিচ্ছেন। আপনি কেন ৪ টাকা মিলানোর সুযোগ দিচ্ছেন না? আমি আপনাকে ৪ টাকা মিলিয়ে দিচ্ছি, দেবেন ৫০০ টাকা?’ জাদুকর বুঝতে পারল, তার জাদু ধরা পড়ে গিয়েছে। দর্শকদের মাঝেও এক ধরনের কানাঘুষা চলছে। জাদুকর দ্রুত তার তল্পিতল্পা গুছিয়ে মঞ্চের পেছন দিক দিয়ে চলে গেল।
এদিকে পাঁচ বন্ধু রাদিনদের বাড়িতে চলে আসলো। বাড়ি এসে রিয়ান তার ব্যাখ্যাটা বাকি বন্ধুদের জানাল। সবার খুব পছন্দ হল। জাদুর মোহে পড়ে ওদের সময় নিয়ে খেয়ালই ছিল না। সানির ঘড়িতে দেখল, ততক্ষণে রাত দশটা বেজে গেছে। তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়তে চাইল কিন্তু রাদিনের মা তাদের না খাইয়ে আসতে দিবে না। ওরা জাদু দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেই তিনি সবার জন্য স্পেশাল বিরিয়ানি রান্না শুরু করেছিলেন। খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বেরুতে বেরুতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। ওদের অঞ্চলে চোর ডাকাতের ভয় ছিল না। তাই অনেক রাত হলেও তারা নির্দ্বিধায় নিদিরপুর গ্রামে ফিরতে পারবে। উঠোনে বেরিয়ে দেখল ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাবিব বলল, ‘ও আজকে তো অমাবস্যা।’ রাদিনদের বাড়িতে কোনো লাইট ছিল না, তবে একটি হারিকেন ছিল। হারিকেন কেরোসিন দিয়ে ভর্তি করে রাদিনের মা বল্টুর হাতে দিল। রাদিন বলল, ‘আমি হিসাব করে দেখেছি, সম্পূর্ণ কেরোসিন ভর্তি অবস্থায় এই হারিকেন সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট জ্বলবে।’ চার বন্ধু বিদায় নিয়ে বেরুল। সানি ঘড়িতে সময় দেখল ঠিক ১১টা বেজে ৮ মিনিট। হাঁটতে হাঁটতে যখন ওরা সাঁকোটির কাছে পৌঁছল, তখন ঘড়িতে ঠিক ১১টা ৩১ বাজে। হারিকেন ছাড়া সাঁকো পার হওয়া অসম্ভব। অন্ধকার রাতে খালটি পার হতে চার বন্ধু খুব সমস্যায় পড়লো এবার। তারা ভাবতে লাগল, কীভাবে সাঁকো পার হওয়া যায়। যদিও সেটি খাল ছিল কিন্তু তবুও তারা হঠাৎ কুমিরের গর্জন শুনতে পেল। রাত হওয়ায় নদীর কুমিরগুলো হয়ত খাবারের সন্ধানে খালে চলে এসেছে। মুহুর্তেই চার বন্ধু দারুণ একটা বুদ্ধি বের করে ফেলল। সেই বুদ্ধিমত তারা সবাই নিরাপদে খালটি পার হয়ে যখন এই পাড়ে আসলো, তক্ষুণি হারিকেন নিভে গেল। যাই হোক, অন্ধকার হলেও এটা তো তাদের নিজের গ্রাম। পথঘাট সব মুখস্থ। তাদের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ঠিক রাত ১২টা বাজল।
এখান থেকে তোমাদের জন্য দুটি প্রশ্নঃ
(i) জাদুকরটি কেন ৪ টাকার কথা বলল না? রিয়ান কীভাবে জাদুকরের জারিজুরি ধরে ফেলল?
(ii) তারা কিভাবে সাঁকোটি পার হয়েছিল?
আরও ধাঁধা পেতে এখানে ক্লিক করুন....
Comments
Post a Comment