জীবনে অজস্র কোটিবার ব্যবহার করা "যোগ" প্রক্রিয়ার পেছনে এত চমৎকার গণিত যে রয়েছে, তা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই জানে না। এই পোস্টটি প্রধানত মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য।
সংখ্যা ছাড়া আমাদের বর্তমান পৃথিবী অচল। সারাবিশ্বে আমাদের বাহ্যিক কর্মকাণ্ডে 10 ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা প্রচলিত। ডিজিটাল ইলেকট্রনিকসে (স্মার্টফোন, কম্পিউটার) 2 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় কিন্তু সেটা আপাতদৃষ্টিতে চোখে দেখা যায় না।
আমরা যত হিসাবই করি না কেন, যে সংখ্যাই ব্যবহার করি না কেন, তার সবকিছু মাত্র 10 টি অঙ্ক দ্বারা তৈরি। এই 10 টি অঙ্ক হল 0,1,2,3,4,5,6,7,8,9। কেন এগুলোকে আমি অঙ্ক বলছি? অঙ্ক হচ্ছে সংখ্যা পদ্ধতির ক্ষুদ্রতম একক। এক বা একাধিক অঙ্ক দ্বারা সংখ্যা গঠিত হয়। যেমনঃ 25 একটি সংখ্যা যা দুটি অঙ্ক 2 & 5 দ্বারা গঠিত। আবার শুধু 2 বা 5 নিজেই একটি অঙ্ক এবং একটি সংখ্যাও!
এখন দেখি, 10 ভিত্তিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলো কীভাবে গঠিত হয়? মূল অঙ্কগুলোর ভেতরে সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে 9, এখন 9 এর পর কোন সংখ্যা হবে? 9 কে 09 হিসেবে লেখা যায়, এখন যেহেতু 9 এর থেকে বড় অঙ্ক নেই, তাই এর পরবর্তী সংখ্যা পেতে হলে, আগের 0 কে 1 (0 এর পরবর্তী সংখ্যা) বানিয়ে দেই & তার ডানে মূল অঙ্কগুলো ক্রমানুসারে বসাই অর্থাৎ 10, 11,12...। একইভাবে 19 এর পর 20,21,22...।
এখন বড় কোনো সংখ্যা ধরি। যেমনঃ 4723.591 সংখ্যাটি কীভাবে গঠিত হয়? দশমিক সংখ্যা নিয়েছি কারণ যেকোনো পূর্ণসংখ্যাকেই দশমিক সংখ্যায় প্রকাশ করা যায়। যেমনঃ 43 একটি পূর্ণসংখ্যা যাকে 43.00 আকারেও লেখা যায়।
মূল সংখ্যা→ 4 7 2 3 . 5 9 1
ক্রম→ 3 2 1 0 1 2 3
যেকোনো সংখ্যার দশমিক বিন্দু থেকে দশমিক বিন্দুর বামপাশের অঙ্কগুলোকে যথাক্রমে 0,1,2,... & ডানপাশের অঙ্কগুলোকে 1,2,3,... এভাবে চিহ্নিত করতে হবে।
4×10³+7×10²+2×10¹+3×10⁰+5×10⁻¹+9×10⁻²+1×10⁻³
এই লাইনের মান যদি বের করা হয় দেখা যাবে সেটা নিশ্চিত 4723.591 হবে। যেহেতু 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি, তাই সংখ্যাটির প্রতিটি অঙ্কের সাথে corresponding ক্রম 10 এর power বা ঘাত গুণ হিসেবে আসছে।
এখন আমি যদি বলি, 2 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি কেমন হবে? 2 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে অঙ্ক থাকবে মাত্র দুটি এবং সেগুলো হল 0,1। অনুরূপভাবে,
4 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে অঙ্ক থাকবে 0,1,2,3 (4 টি)।
6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে অঙ্ক থাকবে 0,1,2,3,4,5 (6 টি)।
অর্থাৎ, n ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে n টি অঙ্ক থাকবে এবং সেগুলো হবে 0 থেকে ক্রমানুসারে এক এক করে বৃদ্ধি পেয়ে (n-1) পর্যন্ত অর্থাৎ n থাকবে না।
আমাদের সবকিছু তো আমরা 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে করি, তাহলে নতুন কোনো সংখ্যা পদ্ধতি কেন প্রয়োজন? 2 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির ফল হল আধুনিক মোবাইল বা কম্পিউটার। তাই 2 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির বিশেষ নাম আছে, সেটা হল 'বাইনারি' সংখ্যা পদ্ধতি। বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি আবিষ্কারের শুরুর দিকে হয়ত কেউ ভাবতেও পারে নি যে একসময় সেটা দ্বারা এখনকার মত এত আধুনিক ও শক্তিশালী ডিভাইস তৈরি করা যাবে, কে জানে নিকট ভবিষ্যতে আরও কত অত্যাধুনিক ডিভাইস তৈরি হবে? ইতোমধ্যে মানুষ AI (Artificial Intelligence) এর অকল্পনীয় প্রভাব বুঝতে শুরু করেছে। আমাদের চারপাশে আমরা যাই আধুনিক কিছু দেখি না কেন, তার সবকিছু কোনো না কোনো মানুষের অবিশ্বাস্য চিন্তার ফল, স্বাভাবিক চিন্তা থেকে বাইরে এসে চিন্তার ফল। তবে সেসব চিন্তার সবকিছু যে বাস্তব রূপ পেয়েছে; ব্যাপারটা এমন নয়। যাই হোক, ধান ভানতে শীবের গীত শুরু করে দিচ্ছি 😚
এখন ধরে নিচ্ছি, 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির অত্যন্ত চমৎকার কিছু প্রয়োগ রয়েছে, হঠাৎ করে এই সংখ্যা পদ্ধতিতে গণিতের জটিল বিষয়গুলো জলের মত সোজা হয়ে গিয়েছে🙃 তাহলে 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে হিসাব নিকাশ কেমন হবে সেটা আমাদের জানতে হবে। এ পদ্ধতিতে যোগ, বিয়োগ, গুণ বা অন্যান্য প্রক্রিয়া আমাদের 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির মতই হবে নাকি ভিন্ন হবে; সেটা জানতে হবে, বুঝতে হবে। আমি সেটা বিস্তারিত বলব, তার আগে আমরা একটু আমাদের বর্তমানে প্রচলিত 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির যোগ, বিয়োগ বা অন্যান্য প্রক্রিয়া কেমন হয়, তা জানার চেষ্টা করি...
প্রথমে দুটি সংখ্যার যোগ চিন্তা করি।
2 5 6 4
+ 7 1 3 8
= 9 7 0 2 (বোঝার সুবিধার্থে ফাঁকা ফাঁকা করে লিখেছি)
এককের ঘরের 4 & 8 যোগ করলে 12 হয়। এখানে আমরা 2 লিখে হাতের 1 আলাদা রাখি। আসলে এখানে, 12-10×1=2, এভাবে এই 2 লিখি, আর 10 এর 1 গুণ বাদ দিলাম। কেন বাদ দিতে হল? শুধু এককের ঘরের একটি করে অঙ্ক যোগ করেছি, তাই যোগফল এক অঙ্কের কিছু পাওয়ার কথা কিন্তু পেয়েছি 12 যা দুই অঙ্কের, ফলে এই 12 কে এমনভাবে এক অঙ্কে লিখতে হবে যেন মানে কোনো পরিবর্তন না হয়। তাই 10 এর কিছুগুণ হাতে রেখে দিয়েছি।
এবার পরবর্তী ধাপে দশকের অঙ্কদ্বয় 6 & 3 যোগ করে পাই 9, আর আগের 1 সহ পাচ্ছি 10। আগের 1 মানে 10 এর 1 গুণ তথা 10 বাদ দিয়েছিলাম, এখন কেন 10 যোগ না করে 1 যোগ করছি? যখন আমি এক ঘর বামে চলে এসেছি, তখন সেটা কিন্তু আর এককের ঘর নেই, দশকেএ ঘর হয়ে গেছে আর দশকের ঘরের 1 মানেই তো সেটা 10 এর সমতুল্য! এবার, 10-10×1=0, আবার হাতে 10 এর 1 গুণ বাইরে রেখে দিলাম। পরের ধাপে, 5+1=6, আগের হাতের 1 সহ 7। এখন, 7-10×0=7, 10 এর 0 গুণ বাদ দিচ্ছি, তাই হাতের 0 থাকবে। এরকম 10 এর কম পেলে হাতের থাকে না। এভাবে ক্রমান্বয়ে চলবে।
প্রতি ধাপে অঙ্কদ্বয় যোগ করে যদি 10 এর বেশি পাই, তাহলে সেই সংখ্যা থেকে 10 এর কতগুণ বাদ দিলে 10 এর কম পাব, তত হাতের থাকবে। এখন অনেকগুলো সংখ্যা একসাথে যোগ করার ক্ষেত্রে, ধরি এককের ঘরের অঙ্কগুলো যোগ করে 45 পেলাম, তাহলে যোগফলের ঘরে লিখব 45-10×4=5 & হাতের থাকবে 4 কারণ 10 এর 4 গুণ বাদ দিয়েছি। এই যে বারবার 10 এর কতগুণ বলছি, বারবার 10 এর প্রসঙ্গ নিয়ে আসছি, এর কারণ হল আমি 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে যোগ করছি। যেকোনো যোগ আমরা সবাই কচু পাতার পানির মত সহজেই করে ফেলতে পারি কিন্তু তার প্রতিটি ধাপে যে 10 এর এত সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চমকপ্রদ।
এখন আমি অন্য সংখ্যা পদ্ধতিতে যোগ করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। যেকোনো পদ্ধতিতেই যোগ করার মূল প্রক্রিয়াটি একইরকম। উদাহরণস্বরূপ 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি নিচ্ছিঃ
(4 3 2)₆
(1 5 4)₆
+ (2 3 5)₆
= (1 3 0 5)₆
ডানদিকে নিচে ছোট করে 6 লেখার মানে হচ্ছে এই যোগটি 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে করা হয়েছে। আমাদের স্বাভাবিক সংখ্যা পদ্ধতি 10 ভিত্তিক হওয়ায়, আগের যোগটি যেহেতু 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে করেছি, তাই সংখ্যার ডানদিকে নিচে ছোট করে 10 লিখার দরকার পড়ে নি।
এখন এই যোগে, ডানদিক থেকে ১ম ঘরের অঙ্কগুলো যোগ করে পাই, 2+4+5=11 কিন্তু 11 লেখা যাবে না কারণ 11>6, তাই 11-6×1=5 লিখতে হবে & হাতে 1 থাকবে কারণ 1 গুণ কমিয়ে লিখেছি। অতঃপর ডানদিক থেকে ২য় ঘরের অঙ্কগুলো যোগ করে পাই, 3+5+3=11 & সাথে আগের ধাপের হাতের 1 সহ 12 যা 6 থেকে বড়। 12-6×2=0, অর্থাৎ যোগফলের এই ঘরে 0 লিখতে হবে & হাতে থাকবে 2। পরবর্তীতে 4+1+2=7 & হাতের 2 সহ 9, 9-6×1=3, এই ঘরে বসল 3, সর্বশেষ হাতের 1 বসিয়ে চূড়ান্ত যোগফল পেলাম 1305। এই যে যোগটি করলাম, এখানে কিন্তু 6 বা তার বেশি কোনো অঙ্ক ব্যবহৃত হয় নি কারণ এটা 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি, এখানে সবকিছু 0,1,2,3,4,5 দ্বারা গঠিত হবে।
এই যে 1305 পেলাম, সেটা অবশ্যই 6 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে মান, এই সংখ্যাটির 10 ভিত্তিক পদ্ধতিতে মান ভিন্ন হবে। কেন? 10 ভিত্তিক পদ্ধতিতে 6,7,8,9 আছে যা 6 ভিত্তিক পদ্ধতিতে নেই, তাহলে মান তো ভিন্ন হবেই। তাহলে কত হবে? এজন্য সংখ্যা গঠন পদ্ধতিতে যেতে হবে।
(1305)₆ এর সমতুল্য 10 ভিত্তিক পদ্ধতিতে মান হবে 1×6³+3×6²+0×6¹+5×6⁰ = (329)₁₀। এখানে ক্রমগুলো 6 এর ঘাত আকারে আসছে কারণ 1305 সংখ্যাটি 6 ভিত্তিক পদ্ধতিতে ছিল। সুতরাং, (1305)₆ = (329)₁₀।
এবার বিয়োগ নিয়ে আলোচনায় আসি। বিয়োগে আহামরি তেমন কিছু নেই। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ 10 ভিত্তিক সিস্টেমে ছোট অঙ্ক থেকে বড় অঙ্ক বিয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা ছোটটির সাথে 10 যোগ করি এবং পরবর্তী ধাপে হাতের 1 নিয়ে সেটার মান একই রাখি। বিয়োগের ক্ষেত্রে আর নতুন কিছু নেই। আমরা "যত" ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে বিয়োগটা করতে চাই, ছোট অঙ্কের সাথে "তত" যোগ করে পরের ধাপে হাতের 1 নিয়েই করব। উপরে যেমন 10 যোগ করার কথা বলেছি।
চিন্তাশীলদের জন্য নিচে কয়েকটি Home Work দিচ্ছিঃ
1. (374)ₙ+(772)ₙ+(168)ₙ=(1435)ₙ ; n=?
2. (125)₇+(2003)₇+(3241)₇=(x)₁₀ ; x=?
3. 5+4+7=20 ; সম্ভব? সম্ভব হলে কীভাবে?
4. 10+3+8=16 ; সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, কীভাবে?
5. কোনো সংখ্যা ব্যবস্থায় 234 এর পরবর্তী সংখ্যা 240 হলে, সেই সংখ্যা ব্যবস্থার ভিত্তি কত?
6. কখন 2+100+1=110 হবে?
উত্তর আপাতত দিচ্ছি না। উত্তরগুলো কমেন্টে জানাতে পারো...
Comments
Post a Comment