Skip to main content

লিপ ইয়ারের আদ্যোপান্ত

২০২৪ সাল, লিপ ইয়ার যাকে বাংলায় অধিবর্ষ বলা হয়। আজ ২৯শে ফেব্রুয়ারী। সাধারণত প্রতি ৪ বছর পর পর এই দিনটি আসে। সকালে ঘুম ভাঙতেই হঠাৎ মনে হল, আজকের দিনটা তো একটু স্পেশাল। কি করা যায় ভাবছি, তাৎক্ষণিক মনে পড়ল আজকে লিপ ইয়ার নিয়ে লেখা যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ।

পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে সম্পূর্ণ একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড (কিছু সেকেন্ডের কমবেশি বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়)। কিন্তু সাধারণত ৩৬৫ দিনকেই এক বছর হিসেবে ধরা হয়। ফলে প্রতি বছর কিছু বাড়তি সময় হিসেব থেকে বাদ যায় যেটা ঠিক করতে প্রতি ৪ বছর পর ৩৬৬ দিনে ১ বছর ধরা হয়। প্রতি বছরের ঐ বাড়তি সময়কে ৬ ঘন্টা ধরে ৪ বছরে ২৪ ঘন্টা=১ দিন হিসেব করা হয় কিন্তু ঠিক ৬ ঘন্টা তো ছিল না! অর্থাৎ প্রতি ৪ বছরে কিছু সময় বেশি নিয়ে নিচ্ছি, সেটি হল

৪×(১১মিনিট ৪ সেকেন্ড) = ৪৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ড= ২৬৫৬ সেকেন্ড ।

এভাবে প্রতি ৪০০ বছরের ১০০ অধিবর্ষে মোট বেশি নেওয়া সময় হচ্ছে ২৬৫৬০০ সেকেন্ড বা ৩.০৭৪ দিন। অর্থাৎ যদি প্রতি ৪ বছর পর পর অধিবর্ষ ধরি, তাহলে প্রতি ৪০০ বছরে আমরা ৩ দিনের কিছু বেশি সময় এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে কি সমস্যা হত, সেটি শেষে লিখছি। এই বাড়তি সময়ের হেরফের দূর করতে প্রতি ১০০ বছরে ১ দিন কমিয়ে আবার প্রতি ৪০০ বছরে ১ দিন বাড়িয়ে বছরের মোট দিনের হিসাব করা হয়। যেমনঃ ২০০০ সাল অধিবর্ষ, প্রতি ৪ বছর পর পর ২০০৪,২০০৮,...২০৯৬ পর্যন্ত অধিবর্ষ কিন্তু ২১০০ সাল অধিবর্ষ নয়। ২০৯৬ এর পর ৮ বছর পর অধিবর্ষ আসবে। অনুরুপভাবে, ২১৯৬ এর পর ২২০৮ সাল অধিবর্ষ হবে। ২২০০,২৩০০ সাল অধিবর্ষ হবে না কিন্তু ২৪০০ সাল পুনরায় অধিবর্ষ হবে। অবশ্য এতেও সময়ের অতি ক্ষুদ্র কিছু পার্থক্য (০.০৭৪ দিন=৬৪০০ সেকেন্ড=১ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ড) থেকেই যায়। এভাবে প্রতি ৪০০ বছরে ৬৪০০ সেকেন্ড বা প্রতি বছরে ১৬ সেকেন্ড করে এগিয়ে যাচ্ছি। এটুকু কালের গর্ভে বিলীন বলা চলে। এভাবে ১ দিন অগ্রীম পাওয়ার জন্য লাগবে ৮৬৪০০/১৬=৫৪০০ বছর!

অন্যভাবেও এই হিসাবটা করা যায়। ১ সাল থেকে ৪০০ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনা করি। আসলে ২০০১ থেকে ২৪০০ সাল বা ১৮০১-২২০০ সাল পর্যন্ত ধরলেও হবে। মানে ক্রমানুসারে ৪০০ বছরের হিসাব দেখতে চাই। প্রতি ৪০০ বছরে লিপ ইয়ার আসে ৯৭ টা, তাহলে আমাদের হিসাবমতে ৪০০ বছরে মোট ৯৭×৩৬৬×৮৬৪০০+৩০৩×৩৬৫×৮৬৪০০=১২৬২২৭৮০৮০০ সেকেন্ড হয়। পৃথিবীর ঘুর্ণন অনুযায়ী ৪০০×(৩৬৫×৮৬৪০০+৫×৩৬০০+৪৮×৬০+৫৬)=১২৬২২৭৭৪৪০০ সেকেন্ড হয়। তাহলে পার্থক্য হচ্ছে ১২৬২২৭৮০৮০০-১২৬২২৭৭৪৪০০=৬৪০০ সেকেন্ড।

লিপ ইয়ার নির্ণয়ের জন্য আমরা যেসব নিয়ম দেখি, সেটা উপরোক্ত কারণের ফলেই হয়। নিয়মটি হচ্ছেঃ

১. নির্ণেয় বছরটির একক ও দশক উভয় ঘরের অঙ্ক যদি ০ না হয়, তাহলে একক ও দশক স্থানের অঙ্ক দ্বারা গঠিত সংখ্যা ৪ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হলেই সেই বছরটি লিপ ইয়ার হবে। যেমনঃ ১৯৬৮ এর ক্ষেত্রে ৬৮, ৪ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য, তাই লিপ ইয়ার। 

২. যদি একক ও দশক স্থানের উভয় অঙ্কই ০ হয়, তবে সালটি ৪০০ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হলে, বছরটি লিপ ইয়ার হবে। যেমনঃ ২১০০ এর ক্ষেত্রে ২১০০, ৪০০ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয়, তাই ২১০০ লিপ ইয়ার নয়।


আমি পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম এই নিয়ম শিখি, তখনকার গণিত বইয়ে এর উপর অংক ছিল। নিয়মটি নিয়ে তখনই আমার মনে কিছুটা খটকা তৈরি হয়। ঐ ছয় ঘন্টার হেরফের তো প্রতি চার বছরেই ঠিক হয়ে যাচ্ছে, তাহলে কখনো কখনো কেন আট বছর পর লিপ ইয়ার হয়? (১৮৯৬→১৯০৪) এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে নি। নিয়মটি বানানোই হয়েছে এমনভাবে যেন সেটি চার বা আট বছর পর হোক না কেন  উভয় ক্ষেত্রে কাজ করে কিন্তু নিয়মটিই এমন কেন? আমি যখন নটরডেমে পড়ি, তখন আবারও একদিন এই খটকার কথা মনে পড়ে এবং তখন আমি এর গূঢ়ার্থ খুঁজে পাই যা উপরে বর্ণিত আছে।


এবার আসি অধিবর্ষের ইতিহাসে। ৪৫ খৃষ্টপূর্বে প্রাচীন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করার সময় প্রতি চার বছর পর লিপ ইয়ারের ধারণা দেন। অবশ্য তিনি খেয়াল করেন নি যে এতে করে ধীরে ধীরে সময়ের বেশ ভালো পার্থক্য তৈরি হয়ে যাবে। তখন মার্চ মাস থেকে বছর শুরু হত কারণ তখন বসন্তের শুরু। ফলে বছরের শেষ মাস ফেব্রুয়ারীতে বাড়তি ১ দিন যোগ করা হত। লিপ নামটি ল্যাটিন থেকে এসেছে যার অর্থ মার্চ মাস শুরুর ছয় দিন আগে, অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেসময় ওই দিনটি লিপ ইয়ার হিসেবে পালন করা হত। এভাবে চলতে চলতে ১৫৮২ সাল নাগাদ এসে ১০ দিনের হেরফের তৈরি হয়। ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই সমস্যার সমাধান করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াসের পরামর্শে, তখনকার জ্ঞানী ব্যক্তিরা বছরের হিসেবে এই সমন্বয় আনার জন্য সিদ্ধান্ত নেন, ১৫৮২ সালে ৪ঠা অক্টোবরের পরের দিনটি হবে ১৫ অক্টোবর। অর্থাৎ মাঝে ১০ দিন থাকবে না। ১৫৮২ সালে ৪ঠা অক্টোবর বৃহস্পতিবারের পরের দিন ১৫ই অক্টোবর শুক্রবার করা হয়। এই ১০ দিনের ফলেই বিজ্ঞানী নিউটনের জন্ম তারিখ নিয়ে ভিন্নমত তৈরি হয়। যাই হোক, এই উপায়ে সৌর বছরের মাঝে সময়ের যে ব্যবধান তৈরি হয়েছিল সেটা দূর করা হয় এবং পরবর্তীতে যেন এই ভারসাম্যহীনতা আবার না ঘটে, সেজন্য তখন লিপ ইয়ারের প্রবর্তন করা হয়। তিনি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন যেটাতে লিপ ইয়ারের হিসাবটা উপরে বর্ণিত করেছি। শুরুতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার শুধু ইতালি ও স্পেনে ব্যবহৃত হত কিন্তু পরবর্তীতে ১৭৫২ সালে গ্রেট ব্রিটেন গ্রেগরি ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করলে ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

অধিবর্ষ কেন গুরুত্বপূর্ণ? অধিবর্ষ হিসাব না করা হলে প্রতি বছর প্রায় ৬ ঘন্টা করে বাড়তে থাকবে। এভাবে চলতে চলতে একসময় পৃথিবীর ঋতুবৈচিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। সাধারণত আমাদের দেশে ডিসেম্বর-জানুয়ারি শীতকাল থাকে, কিন্তু তখন শীতকাল হয়ে যেতে পারে এপ্রিল-মে বা অন্য যেকোনো মাসে। সহজ হিসাব বলি একটা, প্রতি ৭০০ বছরে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে জুনের পরিবর্তে ডিসেম্বরে গ্রীষ্মকাল শুরু হবে।

একটি মজার ঘটনা বলে শেষ করি। সুইডেন ১৭১২ সালে ফেব্রুয়ারী মাস ৩০ দিনে পালন করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৩০ সালের দিকে খণ্ডকালীন ৩০শে ফেব্রুয়ারী পালন করে। বিস্তারিত ইতিহাস জানতে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করুন।

কে জানে, দূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ ৫৪০০ বছর পরে পূর্বোক্ত ১৬ সেকেন্ডের হেরফের ঠিক করতে হয়ত আবারও কোনো সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ৩০ তারিখ আসবে!

চিন্তাশীলদের জন্য একটি প্রশ্ন দিচ্ছিঃ

আমাদের সময় পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। সেটা ধরলে, বর্তমান ক্যালেন্ডার মতে কত বছর পর ১ দিনের হেরফের হবে?

Comments

Popular posts from this blog

মুক্তপাঠের অনলাইন কোর্স সমুহের কুইজের উত্তর

মুক্তপাঠের অনলাইন কোর্সের সাথে অনেকেই পরিচিত। প্রায় সব কোর্সেই চূড়ান্ত মূল্যায়নে কিছু প্রশ্ন করা যেগুলোতে পাস করাটা বাধ্যতামূলক। যদিও বেশ কয়েকবার চান্স থাকে তবুও অনেক ক্ষেত্রেই ১০০% কোর্স সম্পন্ন করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে এত কষ্ট করেও শেষে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় কোর্সের কুইজগুলোর উত্তর জানা থাকলে কোর্স সম্পন্ন করা খুবই সহজ হয়। যারা কোর্স সম্পন্ন করেছেন কিন্তু কুইজে পাস করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন তাদের জন্য আমি সম্ভাব্য কিছু কোর্সের(মুক্তপাঠে অসংখ্য কোর্স বিদ্যমান+প্রতিনিয়ত কোর্স সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে) কুইজগুলোর সঠিক উত্তর আপলোড করলাম। কুইজের  উত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন বিনিয়োগের প্রাথমিক ধারণা কোর্সের চূড়ান্ত কুইজের সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন বি.দ্রঃ শুধুমাত্র তাদের জন্যই যারা কোর্সটি করেছেন কিন্তু কুইজে পাস করতে পারছেন না বা পাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। আপনি বরং আগে নিজে চেষ্টা করুন, তারপর না পারলে ভিডিও দেখুন। যেকোনো সমস্যায় কমেন্টে জানাতে পারেন....  ফেসবুকে আমি tags: মুক্তপাঠের কুইজের উত্তর...

Mini Militia Old Version Download (3.0.6 & 3.0.47)

২০১৭ সালের দিকে Mini Militia নামের একটি Game ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তখনকার সময়ানুযায়ী সেটি যথেষ্ট উন্নত ছিল। তবে ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় সেটি আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে নি। তাই বর্তমানে PUBG, Free Fire ইত্যাদির ভীড়ে সেটি হারিয়ে গেছে। তবে এখনো অনেকে Mini Militia গেমটি ইন্টারনেটে খুঁজেন। তার সবচেয়ে বড় একটি কারণ হল, এটি খেলার জন্য শক্তিশালী Processor সম্বলিত ফোন লাগে না। খুব সাধারণ এন্ড্রয়েড ফোনেও সাবলীলভাবে খেলা যায়। তাছাড়া, ইন্টারনেট ছাড়াই খেলার কারণেও অনেকে খুঁজেন। এর পাশাপাশি শৈশবের স্মৃতি হিসেবে তো রইলই। আমিও তখন এটি অনেক খেলেছি। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের অবরুদ্ধ সময়ে আমরা (আমি, রাকিব, রিফাত, রবিন, মুর্শিদুল, তুষ্টি) আমাদের লটকনতলায় বসে প্রচুর খেলেছি আর গল্পগুজব করেছি।  বর্তমানে ঐ সময়ের গেমটি (পুরাতন ভার্সন) আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা বেশ কয়েকজন সেটি খুঁজতে প্রচুর সময় ব্যয় করেছি। এমনকি প্রায় দশ পনেরোটি ভিন্ন ভিন্ন গেম ইন্সটল করেও সেটি আর পাই নি। কাকতালীয়ভাবে আমার মতই কোনো একজনের কাছে সেই সময়ের গেমটি পেলাম। আমার কাছে একটি ছিল। আমি ড্রাইভে আপলোড করে রেখেছিলাম। বুঝতে...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ব্যাঙ্গাত্বক কথোপকথন

রবীন্দ্রনাথ: "কবি, করিয়াছো ভূল, রাখোনাই দাঁড়ি রাখিয়াছো চুল" । নজরুল:  "অন্তরে বিশ্বাস নেই, মিছে করো প্রভুর আশা, প্রভু কি বাবুই পাখি, তোমার দাঁড়িতে বাঁধিবে বাসা?" বি.দ্র. উপরোক্ত লাইন দুটি কোনো কবিতার অংশবিশেষ নয় । ব্যাখ্যাঃ কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমান তাই দাঁড়ি রাখাটা সুন্নত ছিল যদিও তিনি দাঁড়ি রাখেন নি, বরং দাঁড়ি না রেখে চুল রেখেছিলেন, তাই রবীন্দ্রনাথ সেকথাই ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথের দাঁড়িকে বিদ্রোহী কবি বাবুই পাখির বাসার সাথে তুলনা করেছেন। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন তাই আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস নেই, অথচ তিনি প্রভুর আশা করেন। মূলকথা হল, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসটাই আসল, বাহ্যিকরূপ শুধু বাইরের আবরণ ব্যতীত কিছু নয়। ফেসবুকে আমি